মহম্মদপুর (মাগুরা) প্রতিনিধি:
সবুজ ধানক্ষেতের মাঝখানে এক টিনঘর। বাইরে ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা— খালিয়া পাবলিক লাইব্রেরি ও কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার। ভেতরে ঢুকলেই বইয়ের গন্ধ, কাঠের টেবিল, কয়েকটা চেয়ার আর নীরবে পড়ায় মগ্ন কয়েকজন মানুষ। কেউ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কেউ চাকরির বিজ্ঞপ্তি খুঁজছে, কেউবা শুধু মন ভালো করতে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে।
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার খালিয়া গ্রামে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় এই লাইব্রেরির যাত্রা। কয়েকজন বইপ্রেমী তরুণের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ছোট্ট এই বইঘর এখন গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে জ্ঞানের জানালা হয়ে উঠেছে।
প্রায় দুই হাজার বই ও ম্যাগাজিন রয়েছে লাইব্রেরিটিতে— গল্প, ইতিহাস, বিজ্ঞান, কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিশুতোষ সাহিত্যসহ নানা বিষয়ের। বেশির ভাগ বই এসেছে সরকারি সহায়তা ও স্থানীয় দাতাদের অনুদানে। প্রতিদিন এখানে আসেন গ্রামের তরুণ, মধ্যবয়স্ক ও বৃদ্ধরা। ক্ষেতের কাজ শেষে কেউ এসে বসে বই হাতে, কেউ চাকরির প্রস্তুতি নেয়, কেউবা খোঁজে নিজের মতো কিছু সময়।
১৯ বছর বয়সী আয়েশা বেগম নিয়মিত আসেন এখানে। তিনি বলেন, “এখানে বই পড়তে এসে অনেক কিছু শিখেছি। আমাদের মতো গ্রামের মেয়েদের জন্য এটা এক নতুন সুযোগ।”
লাইব্রেরিটি আশপাশের পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চবিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসার সঙ্গে যুক্ত। নিয়মিত আয়োজন হয় পাঠচক্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কর্মদক্ষতা উন্নয়ন ও চাকরিমুখী প্রশিক্ষণের।
তবে স্বপ্নের এই ঘর টিকিয়ে রাখা সহজ নয়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল বুক সেন্টারে (এনবিসি) নিবন্ধিত হলেও অর্থের অভাব নিত্যসঙ্গী।
স্বেচ্ছাসেবী লাইব্রেরিয়ান হাসানুর রহমান বলেন, “গত মাসে বিদ্যুতের বিল দিতে না পেরে প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল লাইব্রেরি। দর্শনার্থীদের সামান্য দানেই কোনোভাবে চালিয়ে নিচ্ছি।”
সন্ধ্যা নামলে ছোট্ট ঘরটিতে জ্বলে ওঠে একটিমাত্র বাতি। সেই আলোয় মুখগুলো ঝলমল করে ওঠে— কৃষক, শিক্ষার্থী, দোকানি, অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ, সবাই বইয়ে ডুবে থাকে। গ্রামের সেই নীরব কোণে তখন জেগে ওঠে জ্ঞানের আরেকটা পৃথিবী।
লাইব্রেরি কমিটির সাধারণ সম্পাদক খিজির হায়াত বলেন, “আমরা চাই জেলা ও উপজেলা প্রশাসন পাশে দাঁড়াক। একটা গ্রামীণ লাইব্রেরিতে বিনিয়োগ মানে আলোকিত বাংলাদেশ গড়া।”
অভাব-সংকট পেরিয়েও খালিয়া লাইব্রেরি বেঁচে আছে স্বপ্নের আলো নিয়ে। প্রমাণ করে দিচ্ছে— মানুষ যদি চায়, বইয়ের আলোয় অন্ধকারকেও হার মানানো যায়।
© All rights reserved © 2025 magurarkagoj.com