দুই বিদ্যালয়ে দুর্নীতি, তদন্তেও অস্পষ্টতা — ‘অভিযোগ দাও, সুবিধা পাবে’
প্রশিক্ষণকে হাতিয়ার বানিয়ে প্রশাসনিক খেলায় শিক্ষক জিম্মি, অডিও ফাঁস
নিজস্ব প্রতিনিধি: ২৭ অক্টোবর ২০২৫(মাগুরার কাগজ)
বাগডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভুয়া কাগজে শিক্ষকতা, তদন্তে নমনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন
মাগুরা সদর উপজেলার বাগডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কৃষি শিক্ষা বিষয়ের সহকারী শিক্ষক মন্নুলাল বিশ্বাসকে নিয়ে অভিযোগ উঠেছে যে তিনি দীর্ঘদিন ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে কৃষি বিষয়ের শিক্ষক নিয়োজিত ছিলেন ও সরকারি বেতন গ্রহণ করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ধীমান রায় ৩ জুলাই ২০২৫ জেলা শিক্ষা অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগে বলা হয়—মন্নুলাল বিশ্বাসের কাছে কৃষি শিক্ষক হওয়ার প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই, তবু তিনি দীর্ঘদিন ওই পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা শিক্ষা অফিসার আলমগীর কবীর ৭ জুলাই ২০২৫ তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির আহবায়ক ছিলেন সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার প্রদ্যুৎ কুমার দাস; অন্য দুই সদস্য ছিলেন এ.এস.এম. মাজেদউর রহমান ও মো. সেলিম রেজা। কমিটি ১০ জুলাই সরেজমিন তদন্ত করে এবং ৩১ জুলাই ২০২৫ জেলা শিক্ষা অফিসে প্রতিবেদন দাখিল করে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে — “ভুয়া কাগজপত্র উপস্থাপনের অভিযোগ পুরোপুরি প্রমাণিত না হলেও মন্নুলাল বিশ্বাসের কৃষি শিক্ষক হওয়ার প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুপস্থিত।” সত্ত্বেও কমিটি তাকে সহকারী শিক্ষক (সমাজবিজ্ঞান) পদে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করেছেন—যা স্থানীয়দের কাছে কেনার মতোই অনাকাঙ্খিত ও প্রশ্নবহ।
অভিযোগকারী ধীমান রায় অভিযোগ করে বলেন, “যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও একজন ব্যক্তি কিভাবে দীর্ঘ বছর ধরে কৃষি বিষয়ে শিক্ষকতা করতে পারেন? তদন্ত কর্মকর্তারা বিষয়টিকে হালকা করে দেখেছেন।” স্থানীয় শিক্ষক ও অভিভাবকরা বলছেন, তদন্তে প্রশাসনিক নমনীয়তা ও দায়মুক্তির প্রবণতা স্পষ্ট। তাদের দাবি—যদি যোগ্যতা না থাকে, তাহলে উপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে; পদান্তর করে ‘অবহেলা’ করে দেওয়া মানে অনিয়মকারীদের পুরস্কৃত করা। 
অভায়াচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারি, তদন্তে ধোঁয়াশা
মাগুরা জেলা, শালিখা উপজেলার অভায়াচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মমতা রানী মজুমদার-এর বিরুদ্ধে ২০১৯–২০২৫ সময়কালে বিদ্যালয়ের টিউশন ফি, আয় ও সম্পত্তি বিক্রয় থেকে সৃষ্ট আয়ের ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় রুপকুমার বর ১১ নভেম্বর ২০২৪ জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয়—বিদ্যালয়ের আয়ের টাকা সঠিকভাবে হিসাব না রেখে আত্মসাৎ করা হয়েছে; এমনকি শিক্ষকের স্বামীর নামে ব্যাংক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে—২০১৯–২০২৫ সময়কালে বিদ্যালয়ের টিউশন ফি, পুকুর ইজারা এবং গাছ ও পুরাতন ভবন বিক্রির অর্থের যথাযথ হিসাব নেই; ২০২৪ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে ১,৩০,০০০ ও ৬০,০০০ টাকা উত্তোলনের রেকর্ড পাওয়া গেছে, তবু ব্যয়ের কাগজপত্র নেই। অভিযোগকারী আরও বলেন, বিদ্যালয়ের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক মিলে ‘সিন্ডিকেট’ করে বিদ্যালয় পরিচালনা করছেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—বিদ্যালয়ের ক্যাশবই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অফিসে জমা থাকায় পূর্ণাঙ্গ আর্থিক যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়নি। কিছু অভিযোগ আংশিক সত্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে; তবু “পূর্ণপ্রমাণের অভাব” বলে গঠনমূলক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়নি। স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলেছেন—ক্যাশবই অনুপস্থিত থাকলে কেন সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে তা অনুরোধ করা হয়নি, এবং কেন মূল হিসাব-বই জোগাড় না করে তদন্ত শেষ করা হল।
শিক্ষক ও অভিভাবকরা তদন্ত কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দিহান এবং উচ্চপর্যায়ের স্বাধীন পুনরায় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।

প্রশিক্ষণে শিক্ষককে বাধ্য করে অভিযোগ লিখানো—অডিও ক্লিপে প্রশাসনিক ষড়যন্ত্রের ছায়া
প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া কয়েকজন শিক্ষক জানান, তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে বলা হয়েছিল যে তারা লিখিতভাবে “খাবার ও ব্যবস্থাপনা নিম্নমানের” এইসব অভিযোগ করতে। একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষক বলেন, “আমাদেরকে বলা হয়েছিল—ডিও স্যার বদলি হলে এডিও প্রদ্যুৎ স্যার দায়িত্ব পাবেন; তখন এমপিও ও অন্যান্য কাজে সুবিধা হবে। তাই অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছিল।”
একজন শিক্ষক অফিস সহকারী নজরুল ইসলাম–এর বিরুদ্ধে জেলা শিক্ষা অফিসে লিখিত অভিযোগ করেছেন; অভিযোগে বলা হয়েছে তিনি শিক্ষকদের কাছে নেতিবাচক মন্তব্য নেয়ার চেষ্টা করেছেন এবং জেলা শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করতে চাপ দিয়েছেন, যাতে প্রশাসনিকভাবে প্রদ্যুৎ কুমার দাসকে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখার চেষ্টা করা যায়।
এই ঘটনার একটি অডিও ক্লিপ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে; ক্লিপে পরোক্ষ নির্দেশনার সুর স্পষ্ট মনে হয়—যা স্থানীয়ভাবে প্রশাসনিক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। শিক্ষক সমাজ বলছে, “এটি শুধু ট্রেনিং নয়; এটি প্রশাসনিক কৌশল যেখানে শিক্ষকদের জোর করে ব্যবহার করা হয়েছে।” তারা অডিওটির ফরেনসিক বিশ্লেষণ ও স্বাধীন তদন্ত দাবি করেছেন।

শেষ কথা ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা
ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে জেলা শিক্ষা অফিসার আলমগীর কবীর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে তিনি সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার প্রদ্যুৎ কুমার দাস কবে দায়িত্ব পালন করেন বা অনুপস্থিত থাকেন তা নিয়ে নির্দিষ্টভাবে অবগত নন। জেলা সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার প্রদ্যুৎ কুমার দাসও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। 
স্থানীয় শিক্ষক, অভিভাবক ও সচেতন মহল দাবি করছেন—যদি তদন্তই পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে অনিয়মের বিচার কখনোই হবে না। তারা বলছেন, স্বাধীন, উচ্চপর্যায়ের ও স্বচ্ছ তদন্ত ছাড়া মাঠে কোনো স্থায়ী সমাধান আসবে না।
© All rights reserved © 2025 magurarkagoj.com